মৎস্য খাতে ভ্যালু চেইন : নিরাপদ খাদ্য ব্রান্ডিং
মোঃ কাওছারুল ইসলাম সিকদার
বাংলাদেশের মৎস্য খাত প্রাকৃতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। নদী বিধৌত এ বদ্বীপের সৃষ্টিলগ্ন হতে হিমালয়ের বরফগলা পানির অবিরাম প্রবাহের কারণে মিঠা পানির মৎস্যের যেমন প্রাচুর্যতা ছিল, তেমনি এ অঞ্চল ছিল মৎস্যের অভয়ারণ্য। অসংখ্য প্রজাতির মৎস্য দেশের প্রায় সর্বোত্র পাওয়া যেত। আমিষজাতীয় খাদ্যের বেশির ভাগ পূরণ হতো মিঠা পানির মৎস্য হতে। আর সে কারণে বাঙালির পরিচয় ছিল “মাছে ভাতে বাঙালি”। দেশের সর্বোত্র তথা সকল নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ও ডোবাতে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্যের প্রজনন ও বৃদ্ধি ঘটত। বর্ষার শেষ পর্যায়ে মাছের প্রাচুর্যতার কারণে গ্রামীণ জনপদে মাছ রৌদ্রে শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখত। তাই ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা নববর্ষে মাছ/শুঁটকির সাথে পান্তাভাত পরিবেশন করা হয়। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ও সহজলভ্যতা ঘটলেও মৎস্য খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার মূলত সংরক্ষণ স্তরেই রয়ে গেছে। এ দেশে প্রক্রিয়াজাত মৎস্য শিল্পের বিকাশ তেমনটি আজও লক্ষ করা যায় না।
পানির অভাবে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে দেশের প্রায় সকল নদ-নদী শীর্ণ হয়ে পড়ে। অনেক নদীর শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে যায়। মাছের পরিবর্তে সেখানে শাকসবজি ও ফসলের আবাদ হয়। পানির গভীরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ায় সে সময় অধিকাংশ মাছ ধরা পড়ে যায়। যার কারণে মা মাছসমূহ আর বংশবিস্তার করতে পারে না। তাই দেশে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মাছের চাহিদা পূরণে বর্তমানে কৃত্রিমভাবে জলাশয় তৈরি করে বিশেষ কিছু প্রজাতির মাছের চাষ করা হচ্ছে। দেশের প্রায় সর্বোত্রই কৃত্রিম পদ্ধতিতে এ মাছ চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ খাতকে ঘিরে পুকুর তৈরি, মাটি ও পানির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি ঘটেছে। সেইসাথে মাছের খাবারের জন্য অনেক আধুনিক মৎস্য খাদ্য তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমদানি করা হচ্ছে মাছের খাবারের কাঁচামাল। তবে উৎপাদিত মৎস্য আহরণের পর থেকে ভোক্তা অবধি পৌঁছানোতে দেশে তেমন কোনো প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ও চেইনশপ-ব্রান্ডশপ অদ্যাবধি গড়ে উঠেনি। সৃষ্টি হয়নি মৎস্য উপযোগ সৃষ্টিকারী ধাপ। নেয়া হয়নি মাছের স্বাদের পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আনয়নে দেশী-বিদেশী রেসিপি সংযোজন।
এ প্রজন্মের শিশু-কিশোররা মাছের প্রতি অনেকটা নিরাসক্ত। এর কারণ মূলত মাছ রান্না ও পরিবেশনে বৈচিত্র্যহীনতা। এ দেশে মাংস (হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরু, মাহিষ প্রভৃতি) রান্নায় ব্যাপক বৈচিত্র্য এসেছে। যুক্ত হয়েছে দেশি ও বিদেশী প্রযুক্তি এবং রন্ধন প্রণালী। মাংস দিয়ে তৈরি হচ্ছে হরেক রকমের কাবাব, কিমা, কালিয়া, কোপ্তা, টিকা, রেজালা, কোর্মা, গ্রীলসহ অসংখ্য রেসিপি। অথচ প্রচলিত মাছ ভাজা ও মাছ-তরকারি ছাড়া তেমন কোন ভিন্ন রন্ধন প্রণালী বা রেসিপি দেখা যায় না। মৎস্য খাতে নেই কোন চেইনশপ অথচ মাংসে যুক্ত হয়েছে দেশি ও বিদেশি অসংখ্য ব্র্যান্ডের চেইন শপ। মাংস উৎপাদন ও আমদানি এবং ভোক্তাদের নিকট পৌঁছাতে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক সংরক্ষণ, পরিবহন বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি। পরিবেশনের জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামিদামী রেস্তোরা এবং প্রচারেও ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ।
বাংলাদেশের মৎস্য খাত প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এ খাতে অদ্যাবধি ভ্যালু চেইন (ধাপ) যুক্ত করতে আমরা সক্ষম হয়নি। মৎস্য খাতে নিযুক্ত চাষিরা মূলত মাছ চাষ করে ফরিয়ার মাধ্যমেই মাছ বাজারজাত করছে। তবে ভোক্তার নিকট পৌঁছাতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা বা উপযোগ এখনো তৈরি হয়নি বিধায় মৎস্য চাষিরা উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। অপর দিকে মাছের জন্য তৈরি খাবারের দামের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনাগত খরচ বাড়ায় মাছ চাষ ক্রমেই অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ফলে গ্রমীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণীত হওয়ার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের নিয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে উৎপাদন হতে ভোগ পর্যন্ত খাদ্য নিরাপদ রাখতে সকলস্তরের মানুষ ও খাদ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পালনীয় বিষয়ে বিধি ও প্রবিধিমালা তৈরি করছে। দেশের মানুষের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে যেমন ধারণার ঘাটতি রয়েছে, তেমনি ভুলধারণাও রয়েছে। যার কারণে অনেক নিরাপদ খাবারও মানুষ গ্রহণ করছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে সঠিক তথ্য ও জ্ঞানের অভাব। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমরা প্রায় সর্বোত্র ফরমালিনমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূলের প্রচারণা ও পোস্টার দেখতে পাই, অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত বিষয় হলো শাকসবজি ও ফলমূলে ফরমালিন কোন ক্রিয়া করে না। তাই এতে ফরমালিন ব্যবহারে প্রশ্নই ওঠে না; অথচ অনেক শিক্ষিত জনসাধারণ ফরমালিনের ভয়ে ফল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে হবে। সঠিক তথ্যের অভাবে ভোক্তার ভোগ কমে গেলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের চাহিদা কমে যায়, চাহিদা কমে গেলে দ্রব্যমূল্যও হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে দেশের মোট উৎপাদনও হ্রাস পায়।
কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় যে মাছ চাষ হয় সে মাছ অনেকেই খেতে চান না। তার মূলত কারণ হলো প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাছের তুলনায় চাষের মাছের স্বাদ কম। বদ্ধ জলাশয়ের পানির গুণগতমান অনেক সময় নিম্ন থাকে। এ ছাড়া মাছের খাবারের গুণগত মানও সবক্ষেত্রে যথাযথ থাকে না। তাই চাষের মাছের খাবার ও পরিবেশের উন্নয়ের মাধ্যমে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। মাছ বাজারজাতকালে মাছ চাষে গৃহীত নিরাপদতামূলক ব্যবস্থাসমূহ যদি ভোক্তাদের কাছে তুলে ধরা যায় এবং ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করা যায়। তবেই মাছের ভোগ ও চাহিদা বাড়বে, মূল্যও বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদনও প্রবৃদ্ধি ঘটবে। মৎস্যে নিরাপদতা নিশ্চিতকল্পে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপদতার মানদ-ের সার্বিক চিত্র ভোক্তার মাঝে তুলে ধরতে হবে। যুক্ত করতে হবে যথাযথ মোড়ক, লেবেলিং এবং পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে গ্রহণ করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশেষ করে মৎস্য খাতে ভ্যালু চেইন যুক্ত করতে হবে, যাতে সমাজের উচ্চ ও মধ্যম আয়ের ভোক্তাদের নিকট পৌঁছানো যায় এবং প্রত্যাশিত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
নিরাপদ মৎস্যের নির্ণায়ক হলো- ১) মাছ ভৌত, জৈবিক, কেমিক্যাল ও আলার্জি দূষণ হতে মুক্ত হতে হবে। ২) মাছে ভারী ধাতুর উপস্থিতি যেন না থাকে সেজন্য জলাশয়, পানি ও মাছের খাবার ভারী ধাতু মুক্ত হতে হবে। ৩) প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম রাসায়নিক দূষণ হতে জলাধারা নিরাপদ রাখতে হবে। ৪) প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রন্ধনে ব্যবহৃত মসলা বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হতে হবে। ৫) অর্গানিক রং ব্যবহার করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে “ফিস এন্ড চিপস” এর চেইন শপ রয়েছে। এসব দোকানে সামুদ্রিক মৎস্যের ফিলেট মেরিনেট করে রাখা হয়। ক্রেতার অর্ডার পেলে তৎক্ষণাৎ এসব ফিলেট জৈতুনের তেলে ভেজে চিপসসহ পরিবেশন করা হয়। সুস্বাধু ও হালাল হওয়ার এই মাছ সকল বয়সের ও ধর্মের মানুষের নিকট জনপ্রিয়। আমরাও কোরাল/ভেটকি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মৎস্যের ফিলেট দিয়ে ফিস এন্ড চিপস এর মতো চেইন শপ করতে পারি। দেশি-বিদেশি সকলের নিকট সমাদৃত করতে এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে নিরাপদতার সার্টিফিকেশন। সাধারণত বিদেশীরা সমুদ্রের মৎস্যই ভক্ষণ করে। পর্যটকদের জন্য মিঠা পানির মৎস্য আকর্ষণীয় খাবার হতে পারে। অধিকাংশ দেশে সুমিষ্ঠ পানির প্রাচুর্যতা নেই বিধায় মিঠা পানির মৎস্য তাদের অনেকের কাছে অপরিচিত। তাই অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মৎস্য আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য হিমায়িত মৎস্যের পাশাপাশি রেস্তোরাঁর সম্মুখে জীবন্ত মাছ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় কিছু মাছের রেস্তোরাঁ দেখা যায়, যেখানে শুধু মাছ পরিবেশন করা হয়। এসব রেস্তোরাঁ বেশ জনপ্রিয়, সেখানে প্রায়ই ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ করা যায়। এসব রেস্তোরাঁর সম্মুখে জীবন্ত মৎস্য অ্যাকুরিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। ক্রেতারা পছন্দের মৎস্য চিহ্নিত করে দিলে, রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ সেটি তৎক্ষণাত পরিচ্ছন্ন করে ভেজে পরিবেশন করে। এটির প্রচলন আমাদের দেশেও হতে পারে।
মৎস্য খাতে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে এবং মৎস্য চাষ টেকসই করার জন্য ব্রান্ডিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। সকল স্তরের মানুষের কাছে মৎস্য জনপ্রিয় করার মাধ্যমে সার্বিক চাহিদা বৃদ্ধি ও মৎস্য চাষির প্রাপ্য মুনফা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মাঝে আস্থা অর্জনে মৎস্য উৎপাদন হতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানো অবধি প্রতিটি স্তরে নিশ্চিত করতে হবে মৎস্যের নিরাপদতা, সেইসাথে যুক্ত করতে হবে উন্নত রেসিপি এবং রন্ধন প্রণালীতে আনতে হবে বৈচিত্র্য। যুক্ত করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি। ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে গ্রহণ করতে হবে গবেষণা কার্যক্রম এবং চালাতে হবে প্রচার। বিশেষ করে সব বয়সী মানুষের জন্য পছন্দসই স্বাদের মৎস্য রেসিপি তৈরি করে ব্র্যান্ডিং ব্যবস্থাপনায় চেইনশপের মাধ্যমে ভোক্তা অবধি পৌঁছাতে হবে। তবেই মৎস্য খাতের বিকাশ ঘটবে, মৎস্য চাষিরা কাক্সিক্ষত মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধি হবে। সেইসাথে মৎস্য থেকে প্রাপ্ত সহজপাচ্য আমিষের দ্বারা শিশু-কিশোরদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি মৎস্যখাতের নিরাপত্তা, নিরাপদতার উন্নতি ঘটবে এবং আমিষ জাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণ হবে। সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ জনপদ ও জনপদের মানুষ।
লেখক : উপসচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : addldirector.ict@bfsa.gov.bd